সিলেটে ৬টি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার উপর
সিলেটে ৬টি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার উপর,ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিপাতের কারণে সিলেটে আবারও বাড়ছে বিভিন্ন নদ-নদীর পানি। এরইমধ্যে তিনটি নদীর ৬টি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধির কারণে তৃতীয় দফা বন্যার কবলে পড়েছে সিলেট অঞ্চল। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন কয়েক লাখ মানুষ।
মঙ্গলবার (২ জুলাই) সকাল ৯টায় সুরমা, কুশিয়ারা, সারি গোয়াইন নদীর ৬টি পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। সীমান্তর্বতী উপজেলাগুলোতে বন্যা দেখা দিয়েছে। উপজেলা প্রশাসন সতর্কতা জারি করেছে।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র জানায়, মঙ্গলবার সকাল ৯টায় সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ১১৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। নদীর ওই পয়েন্টে বিপৎসীমা ১২ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটার। সুরমা নদীর সিলেট পয়েন্টে পানি ১০ দশমিক ৭৯ সেন্টিমিটার দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এই পয়েন্টে বিপৎসীমা ১০ দশমিক ৮০ সেন্টিমিটার। আর ১ পয়েন্ট বাড়লেই বিপৎসীমা ছাড়বে।
এছাড়া, কুশিয়ারা আমলশীদ পয়েন্টে ৭১ সেন্টিমিটার, ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে ৯৩, শেওলা পয়েন্টে ২২, শেরপুর পয়েন্টে সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সারি গোয়াইন নদী বিপৎসীমার ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সবকটা নদ নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
পাউবো সিলেটের কর্মকর্তারা বলছেন, সিলেটের সীমান্ত এলাকায় প্রবাহিত নদ-নদীগুলোর পানির বাড়া-কমার বিষয়টি ভারতে বৃষ্টির ওপর নির্ভর করে। সিলেটে কম বৃষ্টি হলেও ভারতের বৃষ্টির ফলে পাহাড়ি ঢলে নিম্নাঞ্চল প্রবাহিত হয়। ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে।
সিলেট জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ১৩টি উপজেলার মধ্যে ১০টি উপজেলার আশ্রয়কেন্দ্রে রোববার পর্যন্ত ৮ হাজার ৩০৮ জন আশ্রয় নিয়েছেন। জেলায় ৬৫৩টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে। এর মধ্যে ১৯৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে লোক উঠেছেন। তবে সিলেট সিটি করপোরেশন ও সদর উপজেলায় আশ্রয়কেন্দ্রে লোকজন নেই।
পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। যার জন্য পানি বাড়ছে। বুধবার পর্যন্ত বৃষ্টিপাত থাকবে। আবহাওয়া ভালো হলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
সিলেট আবহাওয়া অফিসের সহকারী পরিচালক শাহ মো. সজিব হোসাইন জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় সিলেটে ২৯৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। আরও ভারী বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা রয়েছে।
সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান বলেন, বন্যার আগাম প্রস্তুতির কথা আগেই বলা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে
তৃতীয় দফা বন্যা আতঙ্কে সিলেটবাসী একেই বলে মরার ওপর খাড়ার ঘা। গত ৩৫ দিনে দুই দফা বন্যা কবলিত হয়েছে সিলেটবাসী। এর ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে না উঠতেই আবারও চোখ রাঙাচ্ছে বন্যা। টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে নদনদীর পানি দ্রুত বেড়ে এরইমধ্যে সিলেট নগরীসহ জেলার বিভিন্ন স্থান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এতে তৃতীয় দফা বন্যা আতঙ্কে রয়েছে সিলেটবাসী।
ভারতের মেঘালয়ে অতিবৃষ্টির প্রভাবে সিলেটে এই বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর টানা বৃষ্টিতে সব নদ-নদীর পানি আবারও বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে চার নদীর পয়েন্টে পয়েন্টে পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। ফলে তৃতীয় দফায় বন্যার মুখে পড়েছেন এ অঞ্চলের মানুষ। সিলেটের সঙ্গে গোয়াইনঘাট উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
সিলেটে সুরমা, কুশিয়ারা, সারি ও সারিগাঙ্গ নদীর পানি দ্রুত বেড়ে পাঁচটি পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। এছাড়াও আরও ছয়টি পয়েন্টে বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই করছে।
২৭ মে প্রথম দফা বন্যা দেখা দেয় সিলেটে। পরে আবার ১৭ জুন ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েন সিলেটবাসী। দ্বিতীয় দফা বন্যায় সিলেট জেলায় প্রায় ১১ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। এখনও ফেঞ্চুগঞ্জ, ওসমানীনগর ও বালাগঞ্জের মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে। অন্য উপজেলাগুলোতে পানি কমলেও পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে ওঠেনি।
এদিকে, মঙ্গলবার দুপুর ১২ টায় পর থেকে সুরমা নদীর পানি ভারতের সীমান্তবর্তী কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ১১৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে সীমান্তবর্তী কানাইঘাট, জকিগঞ্জ, কোম্পানীগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হচ্ছে।
এ উপজেলার আগে থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ যখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, ঠিক তখনই আবারও তৃতীয় দফায় বন্যার আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। এখন নতুন করে পানি বৃদ্ধিতে বন্যাকবলিতদের দুর্ভোগ-ভোগান্তি আরও বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ভারতের আবহাওয়া বিভাগের তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় (রোববার সকাল ৯টা থেকে সোমবার সকাল ৯টা পর্যন্ত) ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ৩১৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এর আগে শনিবার সকাল ৯টা থেকে রোববার সকাল ৯টা পর্যন্ত ১৮৬ মিলিমিটার এবং শুক্রবার সকাল ৯টা থেকে রোববার সকাল ৯টা পর্যন্ত চেরাপুঞ্জিতে ১৪১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। ফলে সিলেটের সবকটি নদ-নদীর পানি আবারও দ্রুতগতিতে বাড়তে শুরু করে।
সিলেট জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, জেলায় পানিবন্দি রয়েছেন ৭ লাখ ৩৬ হাজার ৬ জন। ২১৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছেন ১০ হাজার ৭১৩ জন। তবে সিলেট সিটি করপোরেশন ও সদর উপজেলায় পানিবন্দি মানুষের জন্য প্রস্তুত রয়েছে আশ্রয় কেন্দ্র।
আরও পড়ুনঃ তৃতীয় দফা বন্যা আতঙ্কে সিলেটবাসী
সিলেটে ৬টি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার উপর,দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু সক্রিয় থাকায় টানা বৃষ্টি হচ্ছে সিলেটে। একই কারণে উত্তর বঙ্গোপসাগর এলাকায় সঞ্চরণশীল মেঘমালা তৈরি হচ্ছে। এ ছাড়া বায়ুচাপের তারতম্যের আধিক্য বিরাজ করছে।
সিলেট আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজিব হোসাইন জানান, মঙ্গলবার সকাল ৬ টা পর্যন্ত ২৯৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। মঙ্গলবারও টানা বৃষ্টি হচ্ছে সিলেটে।
আরও পড়ুন: জনমানবশূন্য সিলেটের পর্যটনকেন্দ্র, শতকোটি টাকা লোকসান
টানা বৃষ্টিতে জনদুর্ভোগ বেড়েছে। বিশেষ করে মঙ্গলবার সকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অফিসমুখী লোকজন যানবাহনের স্বল্পতায় কাকভেজা হয়ে গন্তব্যে পৌঁছেছেন।
এদিকে সুরমা নদীর সিলেট পয়েন্টে পানি বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই। ইতোমধ্যে সিলেট নগরীতে থাকা ৯ টি ছড়া উপচে পানি প্রবেশ করছে অফিস ও বাসাবাড়িতে। নগরীর উপশহর, সোবহানীঘাট, যতরপুর, বাগবাড়ি, ছড়ারপার, মেন্দিবাগ, বাদাম বাগিচা এলাকায় বাসাবাড়িতে ঢুকেছে বানের পানি। নগরবাসী আবারও সীমাহীন ভোগান্তির মধ্যে পড়েছে।
সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজ বলেন, সুরমা তীরবর্তী ১২টি ওয়ার্ডে পানি উঠে গেছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বন্যা পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাচ্ছে। আমরাও প্রস্তুত আছি এই দুর্যোগ মোকাবিলায়, আশ্রয়কেন্দ্র ও ত্রাণ প্রস্তুত করা হচ্ছে।
মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে সারা দেশে আগামী তিনদিন ভারি বৃষ্টিপাত হতে পারে বলে আবহাওয়া পূর্বাভাসে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর।