সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি, স্বস্তি ফিরলেও কমেনি ভোগান্তি
সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি, স্বস্তি ফিরলেও কমেনি ভোগান্তি,সিলেটে চলমান বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। সুরমা কুশিয়ারার পানি কোথাও এক সেন্টিমিন্টার কমলেও অন্য পয়েন্টে বাড়ছে। এদিকে সিলেটে পানিবন্দী মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে।
বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) সকাল ৯টা পর্যন্ত সুরমা কুশিয়ারার সবকটা পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উজানের উপজেলাগুলো থেকে পানি নামতে থাকায় ভাটির উপজেলাগুলোর নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।
মূলত নদী ও হাওরগুলো পানিতে পরিপূর্ণ থাকায় দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিচ্ছে সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি। অন্যদিকে সিলেটে গতকাল বুধবার (৩ জুলাই) পর্যন্ত সাড়ে ৬ লাখ মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। বৃহস্পতিবার সকালে বৃষ্টি কিছুটা কমেছে সিলেটে।
এদিকে নগরের ভেতরে বিভিন্ন এলাকা আজ সকাল পর্যন্ত জলাবদ্ধ অবস্থায় আছে। বাড়িঘর পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় অনেক বাসিন্দা আশ্রয়কেন্দ্র অবস্থান করছেন। অনেকেই আবার ঠাঁই নিয়েছেন স্বজনদের বাড়িতে।
গত ২৯ মে ভারি বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সিলেটে প্রথম বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ৮ জুনের পর পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়। এরপর বন্যার দ্বিতীয় ধাক্কা আসে ১৬ জুন। সেদিন আবার পাহাড়ি ঢলে সিলেটের সীমান্তবর্তী দুই উপজেলা বন্যার কবলে পড়ে। পরে নগর এলাকাসহ জেলার ১৩টি উপজেলায় বন্যা দেখা যায়। গত ১৯ জুন অতিবর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ওইসব উপজেলায় বন্যা বিস্তৃত হয়।
এর মধ্যে ১৭ জুন থেকে সুনামগঞ্জ জেলায় ফের বন্যা দেখা দেয়। পরে মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলায় তা বিস্তৃত হয়। এরপর ২৫ জুন থেকে সিলেট অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অনেকটা উন্নতি হতে শুরু করার মধ্যেই সোমবার (১ জুলাই) থেকে অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে নদীর পানি বেড়ে বন্যা পরিস্থিতি আবারো গুরুতর আকার ধারণ করেছে।
বন্যার পানিতে প্লাবিত এলাকা পরিবর্তিত হলেও সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না। বরং আগে থেকে পানি নিমজ্জিত এলাকাগুলোতে মানুষের দুর্ভোগ ও ভোগান্তি আরো বেড়েছে।
সিলেট জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, সিলেটের ১৩টি উপজেলার মধ্যে আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষ নেই কেবল সিলেট সদর, জৈন্তাপুর ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায়। সীমান্তবর্তী গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, জৈন্তাপুর ও কোম্পানীগঞ্জে বন্যার পানি নামছে। ওসমানী নগর, বালাগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার উপজেলায় দীর্ঘস্থায়ী বন্যার কারণে মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। সদর, জৈন্তাপুর ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা ছাড়া বাকি সব উপজেলায় বুধবার রাত পর্যন্ত ১৯৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছেন ৮ হাজার ৮৯৫১ জন মানুষ।
পানি উন্নয়ন বোর্ড, সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, উজান থেকে নেমে আসা ঢল ও ভারি বর্ষণের কারণে নদীগুলোতে পানি বেড়েছে। ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি বেশি হলে সিলেটে তার প্রভাব পড়ে। আমাদের দেশের বৃষ্টি ও উজানের ঢলে বর্তমান বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড, সিলেটের তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৬৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, যা বুধবার ছিল বিপৎসীমার ৭৪ সেন্টিমিটার ওপরে। সিলেট পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুশিয়ারা নদীর পানি বিয়ানীবাজারের শেওলা পয়েন্টে বিপৎসীমার ৪৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জকিগঞ্জের অমলসিদ পয়েন্টে কুশিয়ারা নদীর পানি বিপৎসীমার ১৫৪ সেন্টিমিটার, ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে কুশিয়ারা নদীর পানি বিপৎসীমার ১০২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এবং শেরপুর পয়েন্টে কুশিয়ারা নদীর পানি বিপৎসীমার ১৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
সিলেট আবহাওয়া অফিসের সহকারি পরিচালক শাহ মো. সজিব হোসাইন জানান, বুধবার সকাল ৬টা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সিলেটে বৃষ্টি হয়েছে ১৮.৪ মিলিমিটার। তবে আজ বৃহস্পতিবার থেকে বৃষ্টিপাত কমে আসতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস।
সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান বলেন, জেলার অভ্যন্তরীণ নদ—নদীর পানি ৬টি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উজানের উপজেলাগুলো থেকে ঢলের পানি নামতে থাকায় ভাটির উপজেলাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতির কোথাও উন্নতি আবার কোথাও অবনতি হচ্ছে। বন্যা পরিস্থিতিতে ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান তিনি।
আরও পড়ুনঃ সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি, স্বস্তি ফিরলেও কমেনি ভোগান্তি
পাহাড়ি ঢল আর বৃষ্টিপাত না থাকায় সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হয়েছে। বিশেষ করে সুরমা জাদুকাটাসহ জেলার নদনদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
সেই সঙ্গে জেলা শহরের সঙ্গে তাহিরপুর উপজেলার সড়কপথে সরাসরি যোগাযোগ সচল হয়েছে এবং দোয়ারাবাজার উপজেলার সঙ্গে সুরমা, লক্ষ্মীপুরসহ তিন ইউনিয়নের সড়ক যোগাযোগ সচল হওয়ায় স্বস্তি ফিরেছে ভাটি অঞ্চলের মানুষদের মনে। তবে স্বস্তি ফিরলেও কমেনি ভোগান্তি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সুরমা নদীর পানি হ্রাস পাওয়ায় নিম্নাঞ্চলের জলাবদ্ধতার পানি অনেকটা কমেছে। শহরের সাহেববাড়িঘাট, তেঘরিয়া, বড়পাড়া, শান্তিবাগ, পশ্চিম নুতনপাড়া, মরাটিলা, সুলতানপুর, পাঠানবাড়ি, হাছনবাহার, হাছনবসত, কালীপুরসহ নিম্নাঞ্চলের পানি নেমেছে। সেইসঙ্গে তাহিরপুর-সুনামগঞ্জ সড়কে পাহাড়ি ঢলের পানি নেমে গেছে।
এদিকে, পানিবন্দি অবস্থা থেকে মুক্তি মিললেও বন্যায় সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় নতুন করে ভোগান্তিতে পড়েছেন নিম্নাঞ্চলের বাসিন্দারা। ভাঙা সড়কের ওপর দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে নারী-পুরুষ ও শিশুদের।
ভোগান্তিতে পড়া মানুষরা বলেন, বন্যার পানিতে আমাদের নাজেহাল অবস্থা। তবে দ্বিতীয় দফার এই বন্যায় সড়কের বেশি ক্ষতি হওয়ায় আমরা চরম ভোগান্তিতে পড়েছি। দ্বিতীয় দফা বন্যায় সড়কের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
পানি কমলেও এখনো সড়ক দিয়ে যাতায়াত করা আমাদের জন্য কষ্টদায়ক হয়ে পড়েছে। চলতি বছরের প্রথম দফা বন্যায় ঘরবাড়ি, ফসলি জমি তলিয়ে গেলো, আর দ্বিতীয় দফা বন্যায় সড়ক ভাঙলো। আমাদের কষ্টের যেন কপালে লেখা হয়ে গেছে। বন্যা হলে আমরা পানিবন্দি হয়ে পড়ি, ঘরবাড়ি ভেসে যায়। অথচ বছরের বছরের এভাবে আমাদের ক্ষতি হলে আমরা বাঁচবো কী করে?
অনন্তপুর গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল্লাহ বলেন, হাওরে প্রচুর পানি টানছে। বৃষ্টি কমে যাওয়ায় পানি অনেকটা কমে গেছে। আকাশে রোদের দেখা পাওয়ায় এতে কিছুটা স্বস্তি মিলেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার বলেন, সুরমা নদীর পানি গত ২৪ ঘণ্টায় ২২ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সেই সঙ্গে শহর থেকে শুরু করে নিম্নাঞ্চলের বসতঘর থেকে পানি নেমে গেছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় পানি আরও কমবে।